রোযার ফযীলত ও গুরুত্ব কুরআন ও হাদিসের আলোকে
রোযা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। এটি আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি এবং তাকওয়া অর্জনের অন্যতম উপায়। কুরআন ও হাদিসে রোযার বিশেষ গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। রমযান মাসে রোযা ফরয করা হয়েছে, তবে নফল রোযারও বিশেষ ফযীলত রয়েছে। রোযা শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম নয়; বরং এটি চরিত্র গঠনের অন্যতম একটি মাধ্যম, যা মুসলমানদের আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সাহায্য করে।
রোযার ফযীলত কুরআনের আলোকে
১. রোযা তাকওয়া অর্জনের অন্যতম মাধ্যম :
আল্লাহ তা’আলা রোযা ফরয করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন: “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” (সূরা আল-বাকারা: ১৮৩)
রোযার মাধ্যমে একজন মুসলমান নিজের প্রবৃত্তিকে সংযত করতে পারে এবং আল্লাহভীতির গুণ অর্জন করতে পারে।
২. রোযা ফরয হওয়ার বিধান :
রমযান মাসে রোযা পালন করা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য আবশ্যক। “সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন তাতে রোযা রাখে।” (সূরা আল-বাকারা: ১৮৫)
৩. রোযার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ দেবেন :
রোযার বিশেষ মর্যাদা হলো, এর প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দেবেন।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “আদম সন্তানের সব আমল তার নিজের জন্য, কিন্তু রোযা আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব।” (সহিহ বুখারি: ১৯০৪, সহিহ মুসলিম: ১১৫১)
এ থেকে বোঝা যায় যে, রোযা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি ইবাদত।
রোযার ফযীলত হাদিসের আলোকে
১. রোযাদারের জন্য দুটি আনন্দ :
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: “রোযাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে: (১) ইফতারের সময় সে আনন্দিত হয় এবং (২) যখন সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, তখন তার জন্য আনন্দ অপেক্ষা করছে।” (সহিহ বুখারি: ১৯০৪, সহিহ মুসলিম: ১১৫১)
২. রোযা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে :
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: “রোযা হলো এক ঢাল, যা তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে।” (সহিহ বুখারি: ১৮৯৪, সহিহ মুসলিম: ১১৫১)
৩. রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে সুগন্ধির চেয়েও প্রিয় :
রাসূল ﷺ বলেন: “রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের ঘ্রাণের চেয়েও সুগন্ধিময়।” (সহিহ বুখারি: ১৮৯৪, সহিহ মুসলিম: ১১৫১)
৪. জান্নাতে বিশেষ দরজা ‘আর-রাইয়ান :
রোযাদারদের জন্য জান্নাতে ‘আর-রাইয়ান’ নামে বিশেষ দরজা রয়েছে, যা দিয়ে কেবল রোযাদাররাই প্রবেশ করবে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: “নিশ্চয়ই জান্নাতে ‘আর-রাইয়ান’ নামে একটি দরজা রয়েছে। কিয়ামতের দিন রোযাদাররা এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে এবং তাদের ছাড়া আর কেউ এতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (সহিহ বুখারি: ১৮৯৬, সহিহ মুসলিম: ১১৫২)
৫. রোযার মাধ্যমে গুনাহ মাফ হয় :
রাসূল ﷺ বলেন: “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখবে, তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।”
(সহিহ বুখারি: ২০১৪, সহিহ মুসলিম: ৭৬০)
৬. রোযা কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে :
রাসূল ﷺ বলেন: “কিয়ামতের দিন রোযা ও কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে: হে আমার প্রভু! আমি তাকে দিনের বেলায় খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত রেখেছিলাম, তাই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন।”**
(মুসনাদ আহমদ: ৬৬২৬, সহিহ)
রোযার গুরুত্ব ও উপকারিতা
১. আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি: রোযা আমাদের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায় এবং আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনে সাহায্য করে।
২. ধৈর্য ও সহনশীলতা: রোযার মাধ্যমে একজন মুসলমান ধৈর্যশীল হয় এবং জীবনের বিভিন্ন পরীক্ষায় সফল হতে পারে।
৩. গরিবদের কষ্ট অনুধাবন: রোযার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ক্ষুধার্ত ও দুঃস্থ মানুষের অবস্থা অনুভব করতে পারে, যা তাকে দানশীল ও পরোপকারী হতে উদ্বুদ্ধ করে।
৪. শারীরিক উপকারিতা: রোযা দেহের অতিরিক্ত চর্বি ও বিষাক্ত পদার্থ দূর করে, পরিপাকতন্ত্রকে বিশ্রাম দেয় এবং সুস্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখে।
৫. তাকওয়া ও আল্লাহর নৈকট্য: রোযার মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহভীতি অর্জন করা, যা মানুষকে গুনাহ থেকে বাঁচায় এবং আখিরাতের মুক্তির পথ সুগম করে।
রোযার করণীয় আমল
রমযান মাসে রোযা পালনের পাশাপাশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল করা উচিত:
✅ ফজরের আগে সেহরি খাওয়া (সেহরিতে বরকত রয়েছে – সহিহ মুসলিম: ১০৯৫)
✅ নিয়ত করা (রোযার জন্য নিয়ত করা আবশ্যক)
✅ মিথ্যা, গীবত ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা
✅ ইফতার দ্রুত করা (সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা সুন্নাত – সহিহ বুখারি: ১৯৫৭)
✅ তরাবিহ নামাজ আদায় করা
✅ কুরআন তিলাওয়াত করা
✅ বেশি বেশি দোয়া ও ইস্তিগফার করা
✅ গরিব-অসহায়দের দান-সদকা করা
উপসংহার
রোযা শুধু একটি ইবাদত নয়, বরং এটি আত্মগঠনের একটি মহান সুযোগ। এটি আমাদের ধৈর্যশীল, সংযমী ও ন্যায়পরায়ণ হতে শেখায়। কুরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, রোযা পালনকারীদের জন্য জান্নাতের বিশেষ নেয়ামত অপেক্ষা করছে। তাই আমাদের উচিত, রমযানসহ সারাবছর নফল রোযা রাখা, আত্মশুদ্ধির পথ অনুসরণ করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
আল্লাহ আমাদের সকলকে রোযার প্রকৃত ফযীলত ও গুরুত্ব বুঝার এবং যথাযথভাবে তা পালন করার তাওফিক দান করুন। আমীন!